আপডেট

Saturday, January 24, 2015

উবুন্টুর কথা

একদশক আগেও লিনাক্সের নাম শুনলে চোখের
সামনে ভেসে উঠত এক লোকের ছবি যে কিনা মোটা চশমার ফাঁক দিয়ে কম্পিউটারের
কালো স্ক্রিনে কঠিন কঠিন কোড খটাখট করে করে লিখে যাচ্ছে পরমানন্দে। জন্মের
পর থেকেই লিনাক্স এই জাতীয় গিকদের সাথে এমনভাবে সেঁটে গেছে যে একে আলাদা
করার চিন্তা কারো মাথায় আসেনি। তাই সাধারন কম্পিউটার ব্যবহারকারি যারা
কিনা নন-গিক তাদের কথা তেমনভাবে কখনোই চিন্তা করা হয়নি, ফলে ডেস্কটপের
জন্য সাবলীল কোন লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম তেমনভাবে আসেনি।


পরবর্তী সময়ে ডেবিয়ান, ম্যানড্রিভা, স্ল্যাকওয়ার বা রেডহ্যাটের
ফেডোরা ডেস্কটপের জন্য লিনাক্স ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম বানানো শুরু
করলেও পুরোপুরি গ্রাফিকাল ইন্টারফেস না হওয়ায় সেগুলো সেভাবে জনপ্রিয়
হয়ে উঠেনি। ফলে লোকজনের মধ্যে লিনাক্স-ভীতি সবসময়ই কাজ করত। এই ভীতিটাই
সাধারন মানুষকে লিনাক্স থেকে সবসময় একটা দেয়াল করে আড়াল করে রাখতো। সেই
ভীতিকেই একেবারে দূর করার আশ্বাস দিয়ে আটঘাট বেধে হাজির হল উবুন্টু।


“উবুন্টু” হল একটি দক্ষিন আফ্রিকান শব্দ, যার অর্থ হল “humanity to
others” বা “সবার জন্যই মানবতা”। অপারেটিং সিস্টেম উবুন্টুর লক্ষ্য হচ্ছে
মানুষ যাতে কম্পিউটারে বিনামূল্যে অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে পারে।
শুধু তাইনা, ওপেন সোর্সের মন্ত্রে উজ্জীবিত উবুন্টুও বিশ্বাস করে যে
কমপিউটার সফটওয়ার কারো কুক্ষিগত হতে পারেনা, সবাই স্বাধীনভাবে এটা
ব্যবহার করার অধিকার রাখে। সেজন্য উবুন্টু ব্যবহার করতে কোন টাকা পয়সা
দিতে হয়না এবং এই বিনেপয়সার উবুন্টু ব্যবহার করা পুরোপুরি বৈধ।


সবার সাফল্য আসে ধীরে ধীরে কিন্তু উবুন্টুর ক্ষেত্রে সেটা যেন খুব
তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। ব্যবহার সহজ, সাবলীল ডেস্কটপ, দেখতে সুন্দর ইত্যাদি
কারনে ২০০৪ সালে মুক্তি পাবার দুই সপ্তাহের মাঝেই উবুন্টু মেইলিং লিস্টে
হাজার তিনেকের উপর ম্যাসেজ চলে আসে। গড়ে উঠে উবুন্টু ব্যবহারকারিদের
কমিউনিটি। এই কমিউনিটিই উবুন্টুর মূল শক্তি। এরাই উবুন্টুকে চালাচ্ছে,
উবুন্টুর জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্টেশন করছে, উবুন্টুর প্রচারনা চালাচ্ছে, কেউ
উবুন্টু নিয়ে সমস্যায় পড়লে সেটাকে সমাধান করার জন্য সবাই ঝাপিয়ে
পড়ছে – সবই করছে নিঃস্বার্থভাবে, সবাই যেন একটা বিশাল পরিবার। এই
পরিবারের ব্যাপ্তি সারা পৃথিবী জুড়ে। আর দিনকেদিন এর ব্যাপ্তি বেড়েই
চলেছে। লিনাক্স বেজড কোন অপারেটিং সিস্টেমের ইতিহাসের সবচেয়ে বিশাল
কমিউনিটি হচ্ছে উবুন্টুর। শুধু তাইনা ডেস্কটপ ব্যবহারেও লিনাক্স বেজড
অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেমের তুলনায় উবুন্টুর ব্যবহারকারিও অনেক বেশি।


উবুন্টুর সাফল্যের ইতিহাস এখানেই শেষ না। ডেল, এইচপি, আইবিএম এর মত বড়
বড় কম্পিউটার নির্মাতা কম্পানি উবুন্টুকে বেছে নিয়েছে। গুগলের মত
জায়ান্ট কম্পানিও ব্যবহার করে উবুন্টু । তাছাড়া ফ্রেঞ্চ পুলিশ,
অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি বা অক্সফোর্ড
ইউনিভার্সিটির আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টসহ অনেকেরই প্রথম পছন্দ এখন উবুন্টু।
উইন্ডোজ আর ম্যাক ওএসের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দী হিসেবে উবুন্টু ইতিমধ্যেই
জায়গা করে নিয়েছে। ইন্টেলও উবুন্টুর সাথে কাজ করছে তাদের নতুন
প্রসেসরের চিপ ডিজাইনিং এর জন্য।


কুবুন্টু, জুবুন্টু, লুবুন্টু হচ্ছে উবুন্টু’র বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট বা
রূপভেদ। এরা সবাই আদতে উবুন্টুই কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এদের সবগুলোকেই
ক্যানোনিকাল তৈরি করে। এদের সবগুলোই একই সাথে রিলিজ হয়। এদের মধ্যে
পার্থক্য কেবল এদের ডেস্কটপ এনভায়রনমেন্ট (Desktop Environment বা DE)।


ধরুন আজকে ‘আপনি‘ শার্ট প্যান্ট পড়ে বাইরে গেলেন, আর গতকালকে বের হয়েছিলেন পাজামা পাঞ্জাবি
পড়ে। বলুনতো আজকের আর গতকালকের ‘আপনার‘ মধ্যে পার্থক্য
কিসে? কেবল মাত্র পোশাকে তাইনা! কিন্তু পোশাকের ভেতরের মানুষ আপনি যেমন
ছিলেন তেমনই কিন্তু আছেন, সেখানে কোন পার্থক্য নেই। উবুন্টু আর কুবুন্টুর
পার্থক্যও একই রকম, কেবল বাইরেই ভিন্নতা ভিতরে দুটোই এক। ক্যানোনিকাল
কম্পানি যেই ওএস বানায় সেটার মূল ডিস্ট্র’র নাম হচ্ছে উবুন্টু। উবুন্টু
ব্যবহার করে “গ্নোম” নামের একটি পোশাক আর কুবুন্টু ব্যবহার করে “কেডিই”
নামের আরেকটা পোশাক।


এই পোশাকটাকে লিনাক্সে বলা হয় “ডেস্কটপ এনভায়রনমেন্ট” বা সংক্ষেপে
“ডিই”। এরকম আরো দুটি ডিই হল এক্সএফসিই ও এলএক্সডিই। উবুন্টুর যেই
ভ্যারিয়েন্টটি এক্সএফসিই পোশাক পড়ে থাকে তাকে বলে জুবুন্টু আর যে
ভ্যারিয়েন্টটি এলএক্সডিই’র পোশাক পড়ে তার নাম লুবুন্টু।


এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে ডিই বুঝি উইন্ডোজের স্কিনের বা থিমের মত কোন
ব্যাপার। আসলে সেটা না। উইন্ডোজের থিম পাল্টালে কিন্তু কেবল চেহারাটাই
পাল্টায়, আর কিছু না। কিন্তু লিনাক্স বেজড অপারেটিং সিস্টেমগুলোতে ডিই
পাল্টালে চেহারার সাথে আরো অনেক কিছুই পাল্টে যায় (যেমন মেমরি
কনজাম্পশন, ডিফল্ট এ্যাপ্লিকেশন ইত্যাদি)।


ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, ধরুন আপনি শার্ট পাল্টে পাঞ্জাবি পড়লেন, এতে
কিন্তু আপনার কিছু উপযোগিতা বেড়ে/কমে যায়। যেমন শার্টে বুকের কাছে একটা
পকেট থাকতো যেখানে আপনি পাঞ্জাবিতে কোমড়ের কাছে দুই পাশে দুটা পকেট
পাচ্ছেন। কিংবা আপনি স্যুট পড়লেন, তাহলে আপনার ব্যবহারবিধিও অনেক পাল্টে
যাবে। প্রতিটা ক্ষেত্রে আপনি কেবল পোশাক পাল্টাচ্ছেন কিন্তু সেই সাথে
আপনার অনেক কিছুও পাল্টে যাচ্ছে। ডিই’র ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটাই ঘটে। যেমন
উবুন্টুর (গ্নোমের) ডিফল্ট ফাইল ম্যানেজারের নাম হচ্ছে নটিলাস কিন্তু
কুবুন্টুর (কেডিই’র) ডিফল্ট ফাইল ম্যানেজার হচ্ছে ডলফিন। একইভাবে উবুন্টুর
(গ্নোমের) ডিফল্ট মিউজিক প্লেয়ার হচ্ছে রিদমবক্স যেখানে কুবুন্টুর
(কেডিই’র) ডিফল্ট হচ্ছে এ্যামারক। আবার মেমরি কনজাম্পশনের দিক থেকে
সবচেয়ে কম মেমরিতে চলে লুবুন্টু, লুবুন্টুর চেয়ে বেশি মেমরি নেয়
জুবুন্টু, তার চেয়ে বেশি দরকার হয় উবুন্টু চালাতে আর সবচেয়ে বেশি মেমরি
দরকার হয় কুবুন্টুর জন্য। তাই ডিই পাল্টালে শুধু চেহারাই না বরং কাজের
ধরনও খানিকটা পাল্টে যায়।


উইন্ডোজের থিমের ক্ষেত্রে কিন্তু অন্য ঘটনা ঘটে। আপনি উইন্ডোজে যে
থিমই ব্যবহার করুননা কেন (হোক সেটা এক্সপির র‍য়্যাল ব্লু থীম বা উইন্ডোজ
ক্লাসিক থীম) আপনার ফাইল ম্যানেজার কিন্তু উইন্ডোজ এক্সপ্লোরারই থাকবে
কিংবা ডিফল্ট প্লেয়ার থাকবে উইন্ডোজ মিডিয়া প্লেয়ার। কেবল চেহারাটাই
পাল্টাচ্ছে, এখানেই হচ্ছে উইন্ডোজের থিম আর লিনাক্সের ডিই’র মধ্যে
পার্থক্য। আর পার্থক্যটা বেশ বিশাল।


আপনি উবুন্টুর যেই ভ্যারিয়েন্টই ব্যবহার করুন না কেন তাতে সব
প্রোগ্রামই চালাতে পারবেন। একটার প্রোগ্রাম আরেকটাতে চালানো সম্ভব, কোন
সমস্যা নেই। তাছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি কমান্ড ছাড়া উবুন্টুর সব কমান্ডই
বাকী সব ভ্যারিয়েন্টে কাজ করবে। লিনাক্সের জগতে এরকম প্রচুর ডিই পাবেন।
এসব ডিই’র প্রত্যেকের রয়েছে আবার নিজেদের ফ্যান (ইহা পাংখা নহে, ইহা
ভক্ত)। তাই কোনোটাকে এককভাবে প্রাধান্য দেয়া ঠিক হবেনা। তবে এদের মধ্যে
সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে গ্নোম ও কেডিই। সিমপ্লিসিটি ও ব্যবহারবান্ধবতার জন্য
সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে গ্নোম। আবার প্রচুর অপশন ও রূপলাবণ্যের জন্য
কেডিই’র রয়েছে বেশ নাম ডাক।


মোদ্দা কথা হচ্ছে- উবুন্টু, কুবুন্টু, জুবুন্টু, লুবুন্টু- আপনি যা-ই
ব্যবহার করেননা কেন আসলে আপনি উবুন্টুই ব্যবহার করছেন। এজন্য যখন নতুন
ভার্সনের উবুন্টু রিলিজ হয় তখন একই সাথে একই ভার্সনের অন্যান্য
ভ্যারিয়েন্টগুলোও রিলিজ হয়। তাই ব্যবহারের আগে আপনার প্রয়োজন চিন্তা করে
ব্যবহার করুন যে, কোনটি আপনার জন্য বেশি যুৎসই হবে। আর যদি নিজের প্রয়োজন
না বুঝেন তাহলেও সমস্যা নেই, ১গিগাবাইট বা তার চেয়ে বেশি মেমরি (RAM)
হলে উবুন্টু বা কুবুন্টু চালান আর ৫১২ মেগাবাইটের কম হলে জুবুন্টু বা
লুবুন্টু চালান। তবে ৫১২ মেগাবাইটেও অনেকে উবুন্টু ও কুবুন্টু চালিয়েছেন।
তবে চালাবার আগে দয়া করে এদের সাইট থেকে এদের চালানোর জন্য পিসির
মিনিমাম রিকোয়্যারমেন্ট দেখে নেবেন। যাই হোক, বুন্টু ব্যাটেলিয়ন আপনার
পিসিতে দৌড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছে। তাই বুন্টু ব্যাটেলিয়নের কোন সদস্যকে
বেছে নেবেন- সেটা পছন্দ করা আপনার পালা।